Thursday, August 25, 2016

বদলে দিতে পারে দেশের অর্থনীতি

সম্ভাবনার শেষ নেই এ দেশে। বেশ কিছু খাত আছে, যেগুলোয় উন্নয়ন ঘটাতে পারলে বিপ্লব ঘটে যেতে পারে দেশের অর্থনীতিতে। এমনই একটি অপার সম্ভাবনাময় খাত পর্যটন। প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের লীলাভূমি চট্টগ্রাম অঞ্চলের কঙ্বাজারে বিশ্বের দীর্ঘতম সমুদ্রসৈকত, হিমছড়ি, ইনানী বিচ, দক্ষিণাঞ্চলের সুন্দরবন, পার্বত্য
চট্টগ্রামের দিগন্তজোড়া সবুজ আর পাহাড়ের গা-ঘেঁষা অাঁকাবাঁকা লেক, একই স্থানে দাঁড়িয়ে সূর্যোদয় আর সূর্যাস্ত অবলোকনের স্থান পটুয়াখালীর কুয়াকাটা আর মায়াহরিণের জাদুমাখা সোনার চর, নৈসর্গিক সৌন্দর্যের আধার সিলেটের জাফলংয়ের পিয়াইন নদীর স্বচ্ছ পানি আর পানির নিচে মাছের খেলা_ সবই আছে এ দেশে। নেই শুধু পর্যটন শিল্প বিকাশের ইচ্ছা আর আগ্রহ। অথচ এসব স্থানকে কাজে লাগিয়ে দেশ আয় করতে পারে শত শত কোটি টাকা। বদলে যেতে পারে দেশের অর্থনীতি।
চট্টগ্রাম : চট্টগ্রামের অর্ধশতাধিক নান্দনিক পর্যটন স্পটের সুপরিকল্পিত উন্নয়নে দেশি-বিদেশি বিনিয়োগ হলে পাল্টে যাবে দেশের অর্থনৈতিক চিত্র। প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের অপার এই সম্ভাবনাময়ী স্পটগুলোতে দেশি-বিদেশি পর্যটকদের আকৃষ্ট করার জন্য সাবির্ক নিরাপত্তা, যোগাযোগ ও বাসস্থানের সুব্যবস্থা হলে বছরে হাজার কোটি টাকার বৈদেশিক মুদ্রা আয় হতে পারে। সুদূরপ্রসারী পরিকল্পনা নিয়ে এগোলে অচিরেই বাংলাদেশ হয়ে উঠতে পারে এশিয়ার অন্যতম পর্যটন সমৃদ্ধ দেশ, এমনটাই মনে করেন অর্থনীতিবিদ,
সমাজবিজ্ঞানী ও এ শিল্পে বিনিয়োগকারীরা। তাদের মতে, মালয়েশিয়া, ইন্দোনেশিয়া, থাইল্যান্ড কিংবা নেপালের চেয়েও বাংলাদেশের রয়েছে হাজার বছরের ইতিহাস ও ঐতিহ্য। পাশাপাশি চট্টগ্রামের রয়েছে বহু পুরনো এবং স্বতন্ত্র সাংস্কৃতিক পরিমণ্ডল। এ অঞ্চলের প্রাকৃতিক সৌন্দর্য ও সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের মেলবন্ধনে এখানে অনায়াসেই পর্যটন শিল্পের দ্রুত বিকাশ সম্ভব। তবে পর্যটন খাতের সুষ্ঠু নীতিমালা না থাকায় এবং পরিকল্পিত বিনিয়োগ পরিবেশ সৃষ্টি না হওয়ায় ইচ্ছা থাকলেও বিনিয়োগে আগ্রহী হয়ে উঠছে না অনেকে। দেশি-বিদেশি বিনিয়োগকারীদের আকৃষ্ট করতে পর্যটন এলাকাগুলোর পরিবেশ-প্রতিবেশের নিশ্চয়তা প্রদানে প্রশাসন ও বাংলাদেশ পর্যটন করপোরেশন সহযোগিতাপূর্ণ ভূমিকার বিকল্প নেই।
যদিও কঙ্বাজার আলাদা জেলা কিন্তু পর্যটন এলাকা হিসেবে এটিকে চট্টগ্রাম থেকে আলাদা করে দেখার সুযোগ নেই। এখানে রয়েছে পৃথিবীর দীর্ঘতম সমুদ্রসৈকত, হিমছড়ি, ইনানী বিচ, টেকনাফের শাহপরীর দ্বীপ,
সেন্ট মার্টিন, ছেঁড়াদ্বীপ প্রভৃতি। অন্যদিকে চট্টগ্রাম নগরী ও আশপাশের এলাকাতে রয়েছে অনেকগুলো পর্যটন স্পট, যেখানে সুপরিকল্পিত বিনিয়োগ হলে অর্থনীতিতে শক্তিশালী হবে দেশ। এগুলোর মধ্যে অন্যতম হচ্ছে পতেঙ্গা সমুদ্রসৈকত, হালিশহর বিচ, ভাটিয়ারি ফরেস্ট, ফয়’স লেক, কনকর্ড এমিউজমেন্ট পার্ক, পারকি সমুদ্রসৈকত, সীতাকুণ্ড ইকোপার্ক, সহস ঝরনা, মিরসরাই মুহুরী প্রজেক্ট, কাপ্তাই হ্রদ, বাঁশখালী ইকোপার্ক, চকরিয়া সাফারি পার্ক প্রভৃতি।
এ অঞ্চলে পর্যটন শিল্প বিকাশের যে অপার সম্ভাবনা রয়েছে, তা ইতোমধ্যে পর্যটন শিল্পনির্ভর দেশ হিসেবে গড়ে ওঠা অনেক দেশের নেই। সমাজবিজ্ঞানীরা মনে করেন, এ ক্ষেত্রে সর্বপ্রথম যে কাজটি করতে হবে তা হচ্ছে পর্যটনকে শিল্প খাত হিসেবে সরকারিভাবে মূল্যায়ন করা। প্রাতিষ্ঠানিক ও আনুষ্ঠানিকভাবে পর্যটনকে শিল্প হিসেবে স্বীকৃতি দিয়ে তা গেজেট আকারে আনতে হবে। তাদের মতে, এখানে পর্যটনের নামে যা হচ্ছে তা বিক্ষিপ্ত কিছু বাণিজ্যিক বিনিয়োগ মাত্র। বাণিজ্যের আগে চিন্তা করতে হবে নান্দনিক দৃশ্যপট তৈরি এবং পর্যটকদের কাঙ্ক্ষিত সুযোগ-সুবিধা নিশ্চিত করা। আর দরকার অবকাঠামোগত উন্নয়নে একটি সুষ্ঠু নীতিমালা। পর্যটন এলাকাগুলোতে কী ধরনের রিসোর্ট হবে, বাণিজ্যিক স্থাপনাগুলো কোথায় কীভাবে হবে
এর নীতিমালা না থাকায় প্রাকৃতিক স্পটগুলোর সৌন্দর্যহানি ঘটছে। অন্যদিকে যোগাযোগ ব্যবস্থা একটি অন্যতম অনুষঙ্গ। এদিকে অবশ্যই গুরুত্ব দিতে হবে। চট্টগ্রামের সঙ্গে সিঙ্গাপুর, হংকং, থাইল্যান্ড ও জাপানের সরাসরি ফ্লাইট সার্ভিস চালু করতে পারলে এখানকার পর্যটন শিল্পের আমূল পরিবর্তন ঘটবে বলে মনে করেন বিশেষজ্ঞরা। তাদের মতে, সহজ যোগাযোগ ও সুযোগ-সুবিধা পেলে হাজার হাজর পর্যটক এখানে ভিড় করবে। বাংলাদেশ পর্যটন করপোরেশনের চেয়ারম্যান মো. মাকসুদুল হাসান খান পর্যটন শিল্পের বিকাশের অপার সম্ভাবনার কথা জানিয়ে বলেন, বিনিয়োগ বোর্ড, আইনশৃঙ্খলা বাহিনী, পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়, বিদেশে বাংলাদেশি দূতাবাস_ প্রত্যেকে নিজ নিজ অবস্থান থেকে একযোগে কাজ করলে এ খাত থেকে বিপুল পরিমাণ বৈদেশিক মুদ্রা আয় করা সম্ভব। তিনি বলেন, টেকনাফের অদূরে সমুদ্রতটের সামব্রাং নামক স্থানে ১১০০ একর ভূমি অধিগ্রহণের কাজ চলছে এঙ্ক্লুসিভ ট্যুরিস্ট জোন করার জন্য। যেখানে শুধু বিদেশি পর্যটকরা প্রবেশাধিকার পাবে।
খুলনা : বিশ্বের একক বৃহত্তম ম্যানগ্রোভ ফরেস্ট সুন্দরবন প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের অপরূপ লীলাভূমি। এখানে দেশি-বিদেশি পর্যটকের সংখ্যা দিন দিন বাড়ছে। কিন্তু দীর্ঘদিনেও বাড়েনি পর্যটকদের সুযোগ-সুবিধা। এখানে পর্যটকদের জন্য নেই চিকিৎসা, আবাসন, বিশুদ্ধ পানি ও পর্যাপ্ত নিরাপত্তার সুবিধা। বনের অধিকাংশ এলাকায় মোবাইল নেটওয়ার্ক না থাকায় পর্যটকরা থাকেন যোগাযোগ-বিচ্ছিন্ন। অথচ এ বিষয়গুলো নিশ্চিত হলে দেশ অর্জন করতে পারে শত শত কোটি টাকা।
বন বিভাগ সূত্রে জানা গেছে, পর্যটকদের কাছে এ বনের সবচেয়ে আকর্ষণীয় পর্যটন স্পট হচ্ছে করমজল বন্যপ্রাণী সংরক্ষণ ও প্রজনন কেন্দ্র, কটকা, কচিখালী, নীলকমল, দুবলার চর, শেখের টেক, মান্দারবাড়িয়া, হারবাড়িয়া, হিরণ পয়েন্ট, দোবেকী, কালিরচর, সুপতি প্রভৃতি এলাকা। সুন্দরবনের পর্যটন স্পটগুলোয় দেখা যায় বিভিন্ন প্রজাতির গাছপালা, বাঘ, মায়াবী চিত্রল হরিণ, রংবেরঙের পাখি, বানর, অজগর, কচ্ছপ, ডলফিন, লোনাপানির কুমির এবং নানা জাতের মাছ। এ কারণেই এখানে ছুটে আসেন লাখ লাখ পর্যটক। গবেষণার জন্য আসেন দেশি-বিদেশি অনেক শিক্ষার্থী ও গবেষক। ৬ হাজার ১৭ বর্গ কিলোমিটার আয়তনের বিশ্বের বৃহত্তম ম্যানগ্রোভ ফরেস্ট এই সুন্দরবন ২৪ ঘণ্টায় কমপক্ষে ছয়বার তার রূপ বদলায়। মধ্য ও গভীর রাতে এক রকম আর চাঁদনী রাতে মোহনীয় রূপে সজ্জিত হয় সুন্দরবন। এ ছাড়া ১২ মাসে এ বন ১২ রূপ ধারণ করে, যা দারুণভাবে বিমোহিত করে পর্যটকদের। রয়েছে কচিখালী সমুদ্রসৈকত থেকে সূর্যোদয় ও সূর্যাস্ত দেখার সুযোগ। এখানে মোট আয়তনের মধ্যে বনভাগের পরিমাণ ৪ হাজার ১৪৩ ও জলভাগের পরিমাণ ১ হাজার ৮৭৪ বর্গকিলোমিটার। এ বনে রয়েছে ৪৫০টি নদ-নদী ও খাল। সুন্দরী, গেওয়া, পশুর, গরান, গোলপাতাসহ ৩৩৪ প্রজাতির গাছপালা, ১৬৫ প্রজাতির শৈবাল ও ১৩ প্রজাতির অর্কিড। বন্যপ্রাণীর বৃহত্তম আবাস স্থল সুন্দরবনে বিশ্বখ্যাত রয়েল বেঙ্গল টাইগার, চিত্রল ও মায়া হরিণ, লোনাপানির কুমির, অজগর, কচ্ছপ, বিশ্বের বিলুপ্ত প্রায় ইরাবতী ডলফিনসহ ৩৭৫ প্রজাতির প্রাণী রয়েছে। রয়েছে ৩০০ প্রজাতির পাখি। ২১০ প্রজাতির সাদা মাছ, ২৬ প্রজাতির চিংড়ি, ১৩ প্রজাতির কাঁকড়া, লবস্টার ও ৪২ প্রজাতির মালাস্কা। অফুরন্ত প্রাকৃতিক সম্পদের লীলাভূমি সুন্দরবনের গুরুত্ব অনুধাবন করে ১৯৯৭ সালের ৬ ডিসেম্বর জাতিসংঘের ইউনেস্কো কমিশন এর কটকা-কচিখালী, নীলকমল, দক্ষিণ তালপট্টি দ্বীপ-মান্দারবাড়িয়া সমুদ্রসৈকতের ১ লাখ ৩৯ হাজার ৭০০ হেক্টর এলাকাকে বিশ্ব ঐতিহ্য (ওয়ার্ল্ড হেরিটেজ) ঘোষণা করে। এসব কারনে সুন্দরবনের নয়নাভিরাম গুরুগম্ভীর মনোমুঙ্কর দৃশ্য ইকো ট্যুরিস্টদের আকর্ষণ করে সব সময়। বন বিভাগ সূত্রে জানা যায়, ২০০৮-০৯ অর্থবছরে ৯৯ হাজার ৪২৭ জন, ২০০৯-১০-এ ১ লাখ ১৭ হাজার, ২০১০-১১-তে ২ লাখ ১৬ হাজার ৭৮৩ জন ও ২০১১-১২ অর্থবছরে ২ লাখ ২৭ হাজার ৩৮ জন পর্যটক সুন্দরবন ভ্রমণ করেন। শেষ বছর রাজস্ব আয় হয় ১ কোটি ১০ লাখ ৬৬ হাজার ৩১৫ টাকা। তবে পর্যটন খাত থেকে বন বিভাগ কোটি কোটি টাকা আয় করলেও নেই পর্যটকদের জন্য চিকিৎসার কোনো ব্যবস্থা। দুটি ভাসমান হাসপাতালের প্রস্তাব দীর্ঘদিন ধরে ফাইলবন্দী। রয়েছে বিশুদ্ধ খাবার পানির প্রকট সংকট। পর্যটকদের জন্য আবাসনের নেই কোনো ব্যবস্থা। তাদের রাত কাটাতে হয় লঞ্চ, বড় ট্রলার বা জালি বোটে। পর্যটকরা জীবনের ঝুঁকি নিয়ে ফিটনেসবিহীন জালি বোটে উঠতে বাধ্য হন। নেই মোবাইল নেটওয়ার্ক। আর অত্যন্ত নাজুক নিরাপত্তা ব্যবস্থা। একই সঙ্গে রয়েছে জলযান ও আধুনিক অস্ত্রের অভাব। এ ছাড়া কোনো নীতিমালা না থাকায় ট্যুর অপারেটরগুলো পর্যটকদের কাছ থেকে ইচ্ছেমতো টাকা আদায় করে থাকে, যা সরকারি কোষাগারে জমা হয় না। সুন্দরবন পশ্চিম বন বিভাগের ডিএফও জহির উদ্দিন আহমেদ বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, এসব সমস্যার সমাধান হলে সুন্দরবনে পর্যটকদের সংখ্যা বেড়ে যাবে। বাড়বে রাজস্ব আয়ও।
রাঙামাটি : প্রকৃতির সৌন্দর্যের আধারে ঘেরা বৈচিত্র্যময় পর্যটন শহর রাঙামাটি। দিগন্তজুড়ে সবুজের সমারোহ। যেদিকে চোখ যায় স্বচ্ছ পানি আর বিস্তীর্ণ সবুজের হাতছানি। এলোমেলো সারিতে সাজানো উঁচু-নিচু ছোট-বড় অসংখ্য পাহাড়। অাঁকাবাঁকা কাপ্তাই লেক। চারদিকেই স্বচ্ছ জলধারা। যেন শিল্পীর তুলিতে অাঁকা এসব দৃশ্য। আর এ দৃশ্যের টানে প্রতিদিন হাজার হাজার পর্যটকের উপচেপড়া ভিড়ে মুখরিত এ পাহাড়ি জনপদ। অর্থনৈতিকভাবে ব্যাপক ভূমিকা রাখলেও পর্যাপ্ত নিরাপত্তা ও সংরক্ষণের অভাবে হারিয়ে যেতে বসেছে রাঙামাটির এসব পর্যটন স্পট।
এখানকার সবচেয়ে বড় সমস্যা পাহাড়ি-বাঙালি সংঘাত। এ কারণে বেশ কিছুদিন পর্যটন মোটেলে তেমন কোনো পর্যটক আসেননি। তবে স্থানীয় প্রশাসন ও সেনাবাহিনীর প্রচেষ্টায় পাহাড়ে মানুষের মনে আস্থা ফিরেছে। মৌসুমের শুরুতেই নগরজুড়ে সৃষ্টি হয়েছে আনন্দমুখর পরিবেশ। পর্যটকের পদভারে পাহাড় এখন উৎসব-এলাকা। মূল শহর থেকে প্রায় চার কিলোমিটার দক্ষিণে অবস্থিত বাংলাদেশ পর্যটন করপোরেশনের হলিডে কমপ্লেঙ্। পর্যটন এলাকায় দৃশ্যমান হ্রদের বিস্তৃত জলরাশি ও দূরে উঁচ-নিচু পাহাড়ের সারি তৈরি করেছে চমৎকার এক নৈসর্গিক আবেশ। ১৯৭৮ সালে পর্যটন করপোরেশন মূল মোটেলটি এবং ছিয়াশিতে আধুনিক অডিটোরিয়াম ও দুই পাহাড়ের সংযোগ দেওয়া কাপ্তাই হ্রদের ওপর ঝুলন্ত সেতু নির্মাণ করা হয়। ৩৩৫ ফুট দীর্ঘ মনোরম ঝুলন্ত সেতুটি পর্যটন কমপ্লেঙ্রে গুরুত্ব ও আকর্ষণ অনেক গুণ বাড়িয়ে দিয়েছে। এ ছাড়া ২০০৮ সালে পর্যটন কর্তৃপক্ষ পর্যটকদের আকৃষ্ট করতে পাহাড়িদের ঘরের মতো তৈরি করে দুটি ট্রাইব্যুল হানিমান কটেজ। কমপ্লেঙ্ েনির্মিত হচ্ছে ১১ কোটি টাকা ব্যয়ে সুইমিং পুল-সংবলিত পাঁচ তারকা মানের একটি মোটেল। এ পাঁচ তারকা মোটেলটি চালু হলে পর্যটন খাতে রাজস্ব আয় বাড়বে দ্বিগুণেরও বেশি বলে আশা প্রকাশ করছে পর্যটন কর্তৃপক্ষ। এ ছাড়া প্রয়োজন নিরাপত্তা। কারণ দেশের পর্যটন স্পটগুলোর মধ্যে রাঙামাটিই সম্ভবত সবচেয়ে বেশি অনিরাপদ। সরকার যদি প্রতিটি বিষয় পর্যবেক্ষণ করে এর সমৃদ্ধিতে এগিয়ে আসে, দেশ হবে অর্থনীতিতে বিশেষ শক্তিশালী।
পটুয়াখালী : এ জেলার পর্যটন কেন্দ্র কুয়াকাটা, ফাতরাবন, গঙ্গামতি ও সোনার চর। এগুলো পূর্ণাঙ্গ পর্যটন নগরীতে রূপ দিতে পারলে বদলে যেতে পারে উপকূলীয় এ জেলার অর্থনৈতিক চাকা। এর মধ্যে কুয়াকাটায় নিরাপত্তা ব্যবস্থা, থাকা-খাওয়ার সুবিধাসহ চিকিৎসা ব্যবস্থা গড়ে উঠেছে। তবে পর্যটনের অন্য জায়গাগুলোতে রয়েছে এ ধরনের সুবিধার অনেকটা অভাব। অন্য এলাকাগুলোতে রয়েছে যোগাযোগ ব্যবস্থার সমস্যাও। এসব এলাকায় সরকারিভাবে যাতায়াত ব্যবস্থাসহ অন্যান্য অবকাঠামোগত উন্নয়ন ঘটাতে পারলে বছরে প্রচুর বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন করা সম্ভব।
বঙ্গোপসাগরের কোল ঘেঁষে দেশের সর্ব দক্ষিণে পটুয়াখালী জেলার কুয়াকাটা, সোনার চর, গঙ্গামতি ও ফাতরার বনে রয়েছে অফুরন্ত প্রাকৃতিক ও কৃত্রিম সৌন্দর্যের স্থান। আশির দশক থেকে দক্ষিণাঞ্চলের সম্ভাবনাময় দেশের দ্বিতীয় বৃহত্তর এ সমুদ্রসৈকত কুয়াকাটার কদর রয়েছে দেশি-বিদেশি পর্যটকদের কাছে। একই স্থানে দাঁড়িয়ে সূর্যোদয় আর সূর্যাস্ত দেখার এটাই দেশের একমাত্র সমুদ্রসৈকত হওয়ায় শীত, গ্রীষ্ম, বর্ষাসহ সব ঋতুতেই পর্যটকদের কোলাহলে দিনরাত মুখর থাকে এ সৈকত। কুয়াকাটার দর্শনীয় স্থান নারিকেল বীথি, ফয়েজ মিয়ার বাগান, জাতীয় উদ্যান (ইকোপার্ক), শ্রীমঙ্গল বৌদ্ধবিহার, সীমা বৌদ্ধবিহার, কাউয়ার চর, লেম্বুর চর, শুঁটকিপল্লীসহ সৈকতের জিরো পয়েন্ট থেকে ১৭ কিমি. পূর্ব ও পশ্চিমে মনোমুঙ্কর সমুদ্রের দীর্ঘ বেলাভূমি, একাধিক লেক সংরক্ষিত বনায়ন যেন পর্যটকদের জন্য অপেক্ষা করছে। কুয়াকাটায় পর্যটকদের সব ধরনের সেবাদানে নিয়োজিত ট্যুরিস্ট সেন্টারগুলো তাদের ভ্রমণতরী ও কাউন্টার নিয়ে বসে থাকে পর্যটকদের জন্য। এখানে রয়েছে ২৫ শয্যাবিশিষ্ট হাসপাতাল, নৌ-পুলিশ ফাঁড়ি, সব ধরনের মোবাইল নেটওয়ার্ক, বিশুদ্ধ পানীয় জলের ব্যবস্থা। পর্যটকরা ঘুরতে এলে নিরাপত্তাহীনতারও কোনো ঘাটতি থাকে না। সৈকতের বেড়িবাঁধ-সংলগ্ন সওজ, পাউবো ও জেলা পরিষদের ডাকবাংলো, এলজিইডি রেস্ট হাউস, পানি উন্য়ন বোর্ড বাংলোসহ গড়ে ওঠা ব্যক্তি মালিকানাধীন প্রতিষ্ঠানসমূহ ঘিরে রেখেছে কুয়াকাটা পৌরসভাকে। রয়েছে ফার্ম অ্যান্ড ফার্মসের বিশাল নারিকেল বাগান। এ ছাড়া সৈকতের বিপণিবিতান ও বিভিন্ন পণ্যের দোকানগুলো সৈকতের বুকে সারিবদ্ধভাবে সাজানো হয়েছে। এসব কারণেই অপরূপ ও আকর্ষণীয় এ সৈকতে দেশি-বিদেশি পর্যটকরা হুমড়ি খেয়ে পড়েন।
সুন্দরবনের পূর্বাঞ্চল খ্যাত ফাতরার বন ও কুয়াকাটার পূর্বদিকে রয়েছে গঙ্গামতি সৈকত। কুয়াকাটায় ঘুরতে আসা পর্যটকরা ফাতরার বনে গিয়ে তাদের মনের খোরাক পোষাতে পারে প্রকৃতির গোছানো বনে বিভিন্ন ধরনের গাছ ছোট বড় লেক রয়েছে শতাধিক। গঙ্গামতিতে বসে সূর্যোদয় ও সূর্যাস্ত অবলোকন করা যায়। আছে সারি সারি নারিকেল বাগান। বিভিন্ন গাছের আলিঙ্গনে রয়েছে প্রকৃতির সুবজ বেষ্টনী। কুয়াকাটা সৈকত থেকে ট্রলার বা লঞ্চযোগে ফাতরার বন ভ্রমণ করা যায়। ফাতরার বনে রয়েছে শালবন, গর্জন, গজারি, গেওয়া, সুন্দরী, গড়াইসহ বিভিন্ন প্রজাতির গাছ। জেলায় আরেক পর্যটন কেন্দ্র অপরূপ প্রাকৃতিক সৌন্দর্যে ভরা বঙ্গোপসাগর তীরবর্তী সোনার চর। এ ছাড়াও দ্বীপচর সোনারচরে আছে হরিণ, বানর, শুকরসহ বহু প্রজাতির দুর্লভ বন্যপ্রাণী। সেই সঙ্গে ২০ হাজার ২৬ হেক্টর সংরক্ষিত বনভূমি। সরকারি-বেসরকারি সমন্বিত উদ্যোগ নেওয়া হলে এগুলোকে গড়ে তোলা যেতে পারে বিশ্বমানের পর্যটন কেন্দ্র। আর পর্যটন সম্ভাবনাকে কাজে লাগিয়ে সমন্বিত উদ্যোগ গ্রহণ করলে এখানে গড়ে উঠতে পারে পর্যটন নগরী। বদলে যেতে পারে দেশের অর্থনীতি।
সিলেট : সমতলভূমির এক প্রান্তে দাঁড়িয়ে আছে সুউচ্চ পাহাড়। পাহাড়ের গায়ে খেলা করছে সাদা মেঘ। বৃষ্টি হলে পাহাড় বেয়ে নেমে আসা ঝরনা ধারার জলে চিকচিক করে সূর্য। অনতিদূরে হাওর। হাওরের বুকে নানা জাতের পাখির ডুবোখেলা। পাহাড়-সমতল-জলাভূমির এমন অপূর্ব সৌন্দর্যের দেখা মেলে কেবল সিলেটে। এ অঞ্চলের মাটির নিচে প্রকৃতি যেমন লুকিয়ে রেখেছে মূল্যবান সম্পদ, তেমনি ওপরে মেলে ধরেছে তার অপরূপ সৌন্দর্য। তাই সিলেটকে বলা হয়ে থাকে পর্যটন নগরী।
পর্যটন শিল্পের অপার সম্ভাবনা রয়েছে সিলেটে। কিন্তু সরকারি-বেসরকারি উদ্যোগের অভাবে এ সম্ভাবনার বিকাশ ঘটছে না। পর্যটন শিল্পের বিকাশ ঘটানো সম্ভব হলে এ অঞ্চলের আর্থ-সামাজিক অবস্থার আমূল পরিবর্তন হতো বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা। হজরত শাহজালাল (রহ.), হজরত শাহপরান (রহ.) থেকে শুরু করে অসংখ্য পীর আউলিয়া ও ধর্মগুরুর স্মৃতিধন্য সিলেট। হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের পুণ্যস্থান হিসেবে পরিচিত উপমহাদেশের ৫১টি পীঠস্থানের মধ্যে সিলেটেই রয়েছে দুটি। এখানে রয়েছে জৈন্তা রাজবাড়ি, মেঘালিথিক পাথরসহ অসংখ্য প্রত্নতাত্তি্বক নিদর্শন। এত সমৃদ্ধ ও সম্ভাবনা সত্ত্বেও উদ্যোগ ও সদিচ্ছার অভাবে সিলেটের পর্যটন শিল্পের আশানুরূপ বিকাশ ঘটেনি। এ অঞ্চলের পর্যটন শিল্প বিকাশে এখন পর্যন্ত সরকারিভাবে কোনো উদ্যোগ নেওয়া হয়নি। তবে আশার কথা, এখানে বেসরকারি উদ্যোগে কিছুটা উন্নয়ন ঘটছে পর্যটন শিল্পের। কিন্তু যথারীতি এ ব্যাপারে সরকার এখনো কুম্ভকর্ণের ঘুমে। বেসরকারি উদ্যোগে নতুন নতুন পর্যটন কেন্দ্র গড়ে উঠলেও প্রাকৃতিক ও প্রত্নতাত্তি্বক সৌন্দর্য রক্ষায় এখনো সরকারি কোনো উদ্যোগ নেই। অথচ সিলেটের পর্যটন শিল্প বিকাশে সরকার উদ্যোগী হলে এ খাত হতে পারে সিলেটের অর্থনীতির অন্যতম চালিকা শক্তি, এমনটাই মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা।
মাত্র কদিন আগেও দেশের একমাত্র জলার বন (সোয়াম্প ফরেস্ট) সিলেটের রাতারগুলে অবস্থিত এটিই বা জানতেন কজন। এখন এই সোয়াম্প ফরেস্টটি সিলেটের অন্যতম পর্যটন কেন্দ্র। প্রতিদিনই এখানে ভিড় করছেন দেশি-বিদেশি শত শত পর্যটক। কিন্তু দেশের একমাত্র এই সোয়াম্প ফরেস্টে যাওয়ার যোগাযোগ ব্যবস্থাও খুব একটা ভালো নয়। জেলার জাফলংয়ের পিয়াইন নদীর স্বচ্ছ পানি, পানির নিচে মাছের খেলা, নদী থেকে শ্রমিকদের পাথর সংগ্রহ, ওপারের খাসিয়া জৈন্তা পাহাড়, দুই পাহাড়ের মাঝখানে ঝুলন্ত সেতু, পাহাড়ের গায়ে হেলান দেওয়া মেঘ, পানের বরজ, খাসিয়াপল্লী, লালাখালের পান্না সবুজ জল, পাংথুমাই ঝরনা, রাতারগুল জলার বন, খাদিম জাতীয় উদ্যান, ভোলাগঞ্জ পাথর কোয়ারি, মৌলভীবাজারের মাধবকুণ্ড জলপ্রপাত, মাধবপুর লেক, লাউয়াছড়া জাতীয় উদ্যান, চা-বাগান, হামহাম জলপ্রপাত, হাকালুকি হাওর, টাঙ্গুয়ার হাওর, ডলুরা, নারায়ণতলা, টেকেরঘাট, যাদুকাটা নদী, লাউড়ের গড়_ এমন অসংখ্য পর্যটন কেন্দ্র রয়েছে সিলেটে। সব মিলিয়ে সিলেট অনন্য। কিন্তু পর্যটন নগরী হিসেবে স্বীকৃতি না পাওয়া, নাজুক যোগাযোগ ব্যবস্থা, দুর্বল অবকাঠামো ও উদ্যোগের অভাবে এখনো সেই অনুপাতে আসছেন না দেশি-বিদেশি পর্যটক। বিপুল সম্ভাবনা থাকা সত্ত্বেও কেবল পরিকল্পনার অভাবে বিদেশি পর্যটক আকৃষ্ট করা যাচ্ছে না। সরকারের সদিচ্ছাই বদলে দিতে পারে সিলেটের পর্যটন সম্ভাবনা। বদলে দিতে পারে দেশের অর্থনীতি।